বুধবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৭

ইচ্ছাপূরনে গণেশজী

                                         


“গণেশ পুরাণ” এর অন্তর্গত একটা ঘটনা বলি। পুরাকালে চন্দ্রবতী নামক এক রাজ্য ছিলো। সেখানে পর পর কয়েক বছর অনাবৃষ্টি ও প্রচণ্ড খরাতে মাঠের ফসল মাঠেই শুকিয়ে গেলো। কৃষকগণ আর ফসল খামারে তুলতে পারলোই না। গবাদি প্রানী সকল বিনষ্ট হতে লাগলো। অনাহারে মানুষও প্রাণ হারাতে লাগল। একদিন দেবর্ষি নারদ মুনি আকাশমার্গে গমনের সময় এই রাজ্যের দুরাবস্থা দেখে অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে কৈলাসে গমন করলেন। হর পার্বতীকে বন্দনা করে বললেন- “প্রভু! এ কি দুরাবস্থা আজ দেখত হল। চন্দ্রাবতী রাজ্যে এমন হাহাকার যে সেখানে মানবেরা খাদ্য জলের অভাবে যন্ত্রনা ভোগ করে মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে। হে প্রভু, হে মাতা। এর থেকে কি মুক্তির উপায় নেই?”

ভগবান শিব বললেন- “হে মহামুনে। অবশ্যই নিবৃত্তির উপায় আছে। আর তাহাদের সকল বিঘ্নের অবসান করবে স্বয়ং বিঘ্নবিনাশক গণেশ।” পুত্র গজাননকে ক্রোড়ে নিয়ে দেবী শঙ্করী আদর স্নেহ প্রদান করে বললেন- “পুত্র। মর্তধামে এবার তোমার মহিমা প্রচার করো।” দেবর্ষি নারদ মুনি তখন গণেশের বন্দনা করে বললেন- “হে গজবক্ত্র। হে গৌরীনন্দন । এবার আপনি কৃপা করে চন্দ্রাবতী রাজ্যের দুঃখ নিবৃত্তি করুন।” এই বলে দেবর্ষি নারদ ব্রাহ্মণের বেশে চন্দ্রাবতী রাজ্যে গেলেন। ভিক্ষা চাইলেন। সেখানের লোকেরা দেবর্ষিকে সম্মান প্রদর্শন করে বললেন- “হে বিপ্রদেব! আমাদের রাজ্যে চরম দুর্দশা। আমরা নিজেরাই অভুক্ত , আপনাকে কি ভিক্ষা দেবো?” দেবর্ষি বললেন- “তাই যদি হয়, তবে তোমরা বিঘ্নহর্তা শিবতনয়ের পূজা কেন করছ না?” লোকেরা বলল- “হে বিপ্রদেব। যদি শ্রীগণেশের পূজা করে আমাদের সঙ্কট নাশ হয়, তবে আমরা তাহাই করবো। কৃপা করে আপনি সেই পূজাতে পৌরহিত্য করুন।”

দেবর্ষি নারদ তখন নিজেই গণেশ মূর্তি নির্মাণ করলেন। পূজাতে বসে প্রার্থনা মন্ত্র উচ্চারন করলেন-

এইভাবে পূজা সমাপন হল। অভাবের সময় তারা সামান্য নৈবদ্য দিয়ে পূজা করেছিলো। হঠাত মূর্তি জীবন্ত হয়ে উঠলো। গজানন আবির্ভূত হলেন। সকলে স্তব স্তুতি করে প্রণাম করলো। গণেশ জী বললেন – “এত সামান্য নৈবদ্য কেন? আমাকে শত হাণ্ডি পরমান্ন অর্পণ করো।” দরিদ্র লোকেরা বলল এই অভাবে এত নৈবদ্য কোথায় পাবো ! গণেশ জী ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন- “সত্বর আমাকে শত হাণ্ডি পরমান্ন নিবেদন করো । আমি খুবুই ক্ষুধার্ত । না হলে তোমাদের গ্রাস করবো।” শেষে অত দুধ ও চাউল শর্করা কোথায় পাবে। খুজে খুজে এক ছটাক দুধ ও সামান্য হাতের তালুতেও ধরে না, সেই রকম চাউল, শর্করা পাওয়া গেলো। গণেশ জী বললেন- “তাই দিয়ে রন্ধন করে সত্বর আমাকে ভোগ নিবেদন করো।” এক বৃদ্ধা ভাবলেন এই সামান্য জিনিষে কি আর শত হাণ্ডি পরমান্ন হবে। আজ নিশ্চয়ই গণেশ জী আমাদের গ্রাস করবেন। দুর্ভিক্ষে মরার থেকে বরং গণেশ ঠাকুরের হাতে মরা ভালো। বুড়ী এই ভেবে রান্না চাপালো। একটু পড় হাণ্ডি খুলে দেখলো পরমান্ন উপচে পড়ছে। সামান্য ঐ এক ছটাক দুধে আর চাউলে যে এত পরমান্ন হয় তা তাদের জানা ছিলো না। নারদ মুনি মনে মনে হাস্য করলেন। ঐ এক ছটাক দুধ, চাউলে শত হাণ্ডি পরমান্ন হলে, গণেশ জীকে নিবেদন করলেন সকলে। সবার বুঝতে বাকী রইলো না যে এটা গণেশজীর কৃপা। শ্রীগণেশ আশীর্বাদ করে বললেন- “আমি তোমাদের সেবায় প্রসন্ন। অচীরে এখানে দুর্ভিক্ষ দূর হবে। বৃষ্টি হবে। অনেক পরিমাণে ফসল হবে। ততদিন এই শত হাণ্ডি থেকে পরমান্ন খেয়ে তোমরা জীবন ধারণ করবে। এই শত হাণ্ডি ততদিন তোমাদের পরমান্ন প্রদান করবে।” সত্যি তাই হল। গণেশ জীর কৃপায় সেই রাজ্যে প্রচুর বৃষ্টি হয়ে খরা দূর হল। প্রচুর ফসল হল। এই ভাবে গণেশ ঠাকুরের লীলা প্রচার হল।

গণেশ হিন্দু দেবতা। শিব ও পার্বতীর পুত্র গণেশ সিদ্ধিদাতা হিসেবে বিশেষভাবে পূজিত হন। তিনি খর্বাকৃতি, ত্রিনয়ন, চতুর্ভুজ এবং হস্তিমস্তক। শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী গণেশের বাহন হচ্ছে ইঁদুর।

গণেশ মঙ্গল ও সিদ্ধির জনক বলে সব দেবতার আগে পূজিত হন। গণেশের গজানন এবং একদন্ত হওয়ার পেছনে পৌরাণিক কাহিনী বিদ্যমান।গণেশপুরাণ বলছে- গণেশই ওঁকাররূপী ভগবান। গণেশ বেদের আদিতে প্রতিষ্ঠিত ও বেদের সারতত্ত্ব। ইন্দ্র ও অগ্নি সহ সকল দেবগণ শ্রীগণেশকে সর্বদা হৃদয়ে ধারণ করেন- ওঁকাররূপী ভগবান্ যো বেদাদৌ প্রতিষ্ঠিতঃ। যং সদা মুনয়ে দেবাঃ স্মরন্তীন্দ্রাদয়ো হৃদি।

গণেশ যে শুধুই আমাদের উমার সন্তান, তা নয়। গণেশ নিত্য, অক্ষরব্রহ্ম এবং শাশ্বত সত্য। মহাশক্তির পুত্র হওয়ার দরুন তিনি অমিত বলবিক্রম সম্পন্ন, আবার স্বয়ং বিষ্ণুর অংশজাত হওয়ায় তিনি পরমতত্ত্বের আধার এবংসর্বজ্ঞানী। গণেশের স্তুতি করেছেন স্বয়ং বিষ্ণু।

পিতা শঙ্করও আপন পুত্রের বিঘ্ননাশ করার শক্তির প্রশংসা করে স্তব করেছেন "দ্বৈমাতুর"-এর। হেরম্ব, গণেশ, একদন্ত, লম্বোদর, গজানন, বিঘ্ননাশ, শূর্পকর্ণ এবং গুহাগ্রজ- শ্রীগণেশের এই অষ্টনাম প্রতিদিন কীর্তন করলে যাবতীয় বিঘ্ন ধ্বংস হয়ে থাকে।

গণেশের জন্মঃ-

বিভিন্ন পুরাণে তাঁর বিভিন্ন জন্মকথা বর্ণিত হয়েছে। ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ বলছে, গণেশ নারায়ণের বরে ভূমিষ্ঠ এবং তিনি সাক্ষাৎ নারায়ণই। বিষ্ণুর ন্যায় তাই তিনিও শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী। বিবাহের পরে সন্তানলাভহেতু বিহ্বল পার্বতীকে মহাদেবই বিষ্ণুর আরাধনা করার নির্দেশ দেন। সেইমত জগদম্বা ব্রতধারণ করে নারায়ণকে পুত্ররূপে কামনা করেন।

অপরদিকে সাক্ষাৎ পরমেশ্বরী ভগবতীকে আপন মাতারূপে লাভ করার বহুদিনের সাধ শ্রীহরির। দুজনের এই ঐশী ইচ্ছার ফলস্বরূপ শ্রীগণেশের আবির্ভাব। দুর্গা হরিকে সন্তানরূপে পেয়ে আহ্লাদিত, হরিও দুর্গাকে "মা" ডেকে পরিতৃপ্ত। বামনপুরাণ আবার ভিন্ন ঘটনা বলছে। হিমালয়দুহিতা উমা আপন দেহমল থেকে লম্বোদর, সর্বসুলক্ষণ, চতুর্ভুজ এক বালকমূর্তির সৃষ্টি করেন। নায়ক (পুরুষ সংসর্গ) বিনা তাঁর জন্ম বলেই তিনি "বিনায়ক" নাম ধরলেন। তবে এ হেন পরমগুণবান, সত্যদ্রষ্টা, জ্ঞানীদের মধ্যে অগ্রগণ্য, বিষ্ণুস্বরূপ গণেশ কিনা গজমুণ্ডধারী! এর সন্দর্ভেও রয়েছে কাহিনী।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের গণেশ খণ্ডে আছে – বিষ্ণুর ইচ্ছায় মহাদেবের পুত্র হিসাবে গণেশের উৎপত্তি হয়েছিল ভিন্নতর পরিমণ্ডলে।বিষ্ণু বুঝতে পেরেছিলেন যে, মহাদেব ও পার্বতীর মিলনের ফলে যদি মহাদেব পার্বতী যদি গর্ভবতী হন, তাহলে পার্বতী একটি অতিকায় দেব-পীড়নকারী পুত্র প্রসব করবেন।মহাদেব -এর এই অনিষ্টকারী পুত্রের জন্মরোধের উদ্দেশ্যে বিষ্ণু একটি কৌশলের আশ্রয় নেন।

মহাদেব-পার্বতীর মিলনের শেষ মুহূর্তে, বিষ্ণু দরিদ্র ব্রাহ্মণ বেশে মহাদেব -পার্বতীর মিলনগৃহের সামনে উপস্থিত হন এবং উচ্চস্বরে ভিক্ষা প্রার্থনা করতে থাকেন। মহাদেব ব্রাহ্মণরূপী বিষ্ণুর সম্মানার্থে দ্রুত মিলন ত্যাগ করেন, এর ফলে তাঁর স্খলিত শুক্র বাহিরে নিক্ষিপ্ত হয়। এই স্খলিত শুক্র থেকেই গণেশের জন্ম হয়।এভাবে গণেশের জন্ম হলেও, পার্বতী তাঁকে নিজপুত্র রূপে গ্রহণ করেন।

গণেশ হলেন গজাননঃ-
শিবপুরাণমতে মহাদেব স্বহস্তে পুত্রের মুণ্ডচ্ছেদ করে ভগবতীর কোপভাজন হয়েছিলেন। ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ বলছে, গণেশের হস্তীমুণ্ড হওয়ার পেছনে হাত রয়েছে শনির। গণেশের জন্মসংবাদ পেয়ে অন্যান্য দেবগণের সঙ্গে শনিও এসেছিলেন দর্শন করতে, কিন্তু আপন সর্বনাশা দৃষ্টির কথা মনে রেখে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইলেন। শনির এহেন আচরণে দুর্গা অসন্তুষ্ট হয়ে বারংবার সন্তানের মুখ দেখতে পীড়াপীড়ি করায় শনি তাকানোমাত্র গণেশের মুণ্ড উড়ে গেল।

হাহাকার স্তব্ধ করতে তখন শিবের নির্দেশে নারায়ণ গিয়ে পুষ্পভদ্রা নদীর তীরে গভীর জঙ্গলে উত্তরদিকে মাথা করে ঘুমিয়ে থাকা এক হাতীর মস্তক কেটে নিয়ে এলেন। ব্রহ্মা সেই মস্তক মৃত বালকের স্কন্ধে জুড়তেই "গজানন" নাম নিয়ে পার্বতীনন্দন পুনরুজ্জীবিত হলেন।যার ছিন্ন শির গণেশের গ্রীবায় সংযোজিত হয়েছিল, সে গজেন্দ্র কে ? ইনিই স্বয়ং ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত ।

একদা মুনিবর দুর্বাসা বিষ্ণুদত্ত পারিজাত ইন্দ্রকে উপহার দিয়েছিলেন । মদগর্বে গর্বিত ইন্দ্র সে পারিজাত নিজে গ্রহণ না করে অবজ্ঞাবশে তা স্থাপন করে ঐরাবতের মস্তকে । তদ্দর্শনে দুর্বাসা অভিসম্পাত করেন । ইন্দ্র শ্রীভ্রষ্ট হবে এবং ঐরাবতেরও মাথা কাটা যাবে । এখানে আর একটি বিষয়ে বেদের একটি মন্ত্রে ইন্দ্রকেই বলা হয়েছে গণপতি । বেদের গণপতি পুরাণে এসে অনেকাংশে রূপান্তরিত হয়েছেন, তা বলাই বাহুল্য । কিন্তু এই রূপান্তরের মধ্যেও বৈদিক সংস্কার অক্ষুণ্ন রাখার তাগিদেই কি ইন্দ্র হস্তীর মস্তক গণেশের হয়ে সংযোজিত ?

গণেশ পূজায় তুলসী বর্জিতঃ-

গণেশের পূজাতে কিন্তু তুলসী সর্বতোভাবে নিষিদ্ধ। শোনা যায়, ধর্মধ্বজের কন্যা তুলসী গণেশের বীর্যবত্তা ও জ্ঞানগরিমা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে প্রণয়ের জন্য আহ্বান করেন। কিন্তু দারপরিগ্রহে অনিচ্ছুক গণেশ সরাসরি তুলসীকে প্রত্যাখ্যান করলে ক্রুদ্ধা তুলসী অভিসম্পাত করেন- "তোমাকে বিবাহ করতে হবেই এবং তুমি দ্বিস্ত্রীর স্বামী হবে।"

রুষ্ট গণেশও পাল্টা অভিশাপ দেন- "তুমি হবে দানবের ভোগ্যা।" দুজনের অভিশাপই সফল হয়েছিল। গণেশ বিবাহ করেছিলেন ঋদ্ধি ও সিদ্ধিকে এবং তুলসী দানব শঙ্খচূড়কে। সেইথেকে গণেশপূজায় তুলসী বর্জিত হয়ে গেল।

সকল পূজার আগে গণেশ পূজা করা হয়ঃ-

বিষ্ণুর কৃপায় হস্তিমুন্ড পেয়ে গণেশ বেঁচে ওঠেন। হস্তিমুন্ড গণেশ যাতে অবহেলিত না হয় সেজন্য বিষ্ণু বিধান দেন যে, সকল পূজার আগে গণেশ পূজা করতে হবে,অন্যথায় কোন পূজাই গৃহীত হবে না। শিবপুরাণে বলা হয়েছে – সবার আগে গণেশ পূজার বিধান দিয়েছিলেন মহাদেব।এছাড়া বিষ্ণু তাঁকে ব্রহ্মজ্ঞান দান করেন।দেবতারা তাঁর আটটি নাম প্রদান করেন।এই নামগুলি হলো- একদন্ত,গজানন,গণেশ,বিনায়ক, লম্বোদর, শূর্পকর্ণ, শ্রীবিঘ্নেশ ও হেরম্ব।ব্রহ্মা তাঁকে কমণ্ডলু দান করেন,যোগপট্ট দেন শিব, ইন্দ্র দেন রত্ন সিংহাসন, সূর্যদেব দেন মণির কুণ্ডল, চন্দ্র দেন মণিমালা, কুবের মুকুট,অগ্নিশুদ্ধ কাপড় দেন অগ্নি, লক্ষ্মী দেন কেয়ুর, রত্নের বলয়, রত্নের নুপূর, সাবিত্রী ও সরস্বতী দেন গলার হার। এছাড়া অন্যান্য দেবদেবী ও মুনি ঋষিরা আরও বহুবিধ উপহার দেন। ধরিত্রী মাতা গণেশকে ইঁদুর দিয়েছিলেন খেলার উপকরণ হিসাবে। কালক্রমে এই ইঁদুর তাঁর বাহন হিসাবে গৃহীত হয়।

গণেশ একদন্তঃ-
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ মতে, শিব-পার্বতীর দ্বাররক্ষক ছিলেন গণেশ। সেখানে পরশুরামের সঙ্গে গণেশের ভীষণ যুদ্ধ হয়। পরশুরামের কুঠারাঘাতে গণেশের একটি দাঁত সমূলে উৎপাটিত হয়; এজন্য গণেশ একদন্ত।

ওঁ গং গণপতয়ে নমঃ

একদন্তং মহাকায়ং লম্বোদরং গজাননম্৷।
বীঘ্নবিনাশকং দেবং হেরম্বং প্রণমাম্মহাম্৷

*****************************************
যদি আপনাদের কোন উপকারে লাগে তাহলে
আপনাদের সামর্থমত সাহায্য করুন।



or Paytm করুন এই নং-
Amit Chakraborty
No. 9830637766

******************************************

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন